শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন: প্রথম সংখ্যা

বেশ রাত হয়েছিল। গীতাঞ্জলি থেকে ফেরার পথে, সঙ্গীত ভবনের পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে একটা দৌড় দিয়েছিলাম পৌষালীর দিকে। বড়োরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে অজান্তেই একটু পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন আমাদের। 
রাত দশটায় শহর বেশ নিস্তব্ধ। সঙ্গীত ভবনে রিহার্সাল শেষের দিকে; অনেক দূর থেকেই ভেসে আসছিল তানপুরা এবং এস্রজের সম্মিলিত সুরধ্বনি। 
জুতোর ধুপ-ধাপ শব্দ, এবং অট্টহাসিতে যেন মুহূর্তের মধ্যে চুরমার হয়ে গেল রাতের স্থির নীরবতা।  
'দৌড়াস না, পরে যাবি তো!'
আবার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে শুরু করলাম। রাস্তার ধারে ল্যাম্প পোস্টের আলোতে উদ্দীপ্ত সরণিতে
নিক্ষেপণ এক জোড়া দীর্ঘ ছায়াছবি। শারাদিন বেশ ঘরাঘুরি হয়েছে। বাকিটা রাস্তা নীরবেই হাঁটছিলাম, কখন যে প্রতীচীর ঠিক কাছে এসে উঠলাম, টের পাইনি।

বাতাসে একটা বেশ শীত শীত ভাব। ঘরের ব্যালকনি থেকে গুরুকুলের উঠান এবং সামনের বাগানের এপার ওপার দেখা যায়। বাদ্যযন্ত্রের ব্যাগ কাধে নিয়ে কয়েকজন পড়ুয়া সাইকেল করে হোস্টেলের পথে রউনা দিচ্ছিল। ফাগুনের এলোমেলো হাওয়া, হাতে এক কাপ কড়া চা, কানে মেঘমল্লারের করুণ গুঞ্জনধ্বনি (গান শোনার তো আর কোনও ঋতু নেই!)- দিনের শেষে
আমাদের এই গান-নেশা-পাগলামোর মধ্যেই নিজেদের ভালোলাগা, অবহেলার মুহূর্ত গুলো কোথায় যেনো লুকিয়ে রেখেছিলাম 

বসন্ত উৎসবের সূত্রপাত হতে আর বেশিদিন দেরি নেই। গুরুকুলে রিহার্সাল চলছে পুরো দমে। ক্যাম্পাস জুড়ে সবাই আজ বিভিন্ন কাজের প্রস্তুতিতে ব্যাস্ত। বেশ সকাল সকালই বেরিয়ে পরেছিলাম। 
'তুইও বেরিয়েছিস?'
শান্তিনিকেতন আশ্রমের গেটে দেখা। 
প্রথম দিন থেকেই হয়তো সবাই বুঝে গেছিল যে আমি স্বভাবে একটু অমিশ্তক। সবাই যদি কোথাও কেনাকাটা করতে ঢোকে, আমি একটু দূরবর্তী স্থানে দাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করি, অথবা ফোনের দিকে চেয়ে থাকি (এটা আবার ভুলবশত অনেকেই একটা বদভ্যাস বলে মনে করেন; সত্যি বলতে, নিজেকে স্বেচ্ছায় অবিনীত প্রমাণ করার ইচ্ছে আমার নেই)। তাই হয়ত ভোরের দিকে ইউনিভার্সিটির চত্বরে একান্তে ঘুরে বেরাতে দেখাটা খুব একটা বিস্ময়কর ছিল না।
'হ্যা, এই একটু পরেই ফিরে যাব।'

'আচ্ছা চল, লাইব্রেরীর রাস্তাটা দিয়ে একটু হেটে আসি।'

নিঃশব্দে হেটে চললাম, সেন্ট্রাল লাইব্রেরী দিকে গাছে ঘেরা রাস্তা ধরে। ক্লাস শুরুর ঘণ্টা এখনও পড়েনি। আমার পথসঙ্গীর মত আমি এখানকার স্থানীয় এলাকাবাসী নই। শহরটা ঠিক মত চিনে নিয়ে এখনও বেশ খানিকটা পর্যটন করা বাকি। 

বাড়ি ফেরার সময় হয়ে উঠেছে, যে কোনো সময় মায়ের ফোন আসবে- সকালের জল খাবার পরিবেশন করা হয় গেছে, তুই এখনও বাইরে? দুজনের মস্তিষ্কই সে কথা এসেছিল হয়ত, ঘড়ির কাঁটায় ৭:৩০ বাজতে না বাজতেই বাড়ির পথে হাটা লাগলাম। দুজনের একসঙ্গে বাড়ি ঢোকাটা কেউই বিশেষ খেয়াল করেনি। 


একটু হালকা বৃষ্টির পর দুপুরের দিকে ঝলমলে রোদ উঠেছে। খানিকটা লাইট-ক্লাসিক্যালের মুড। শিপ্রা বসুর গাওয়া 'বিনি সুতোয় গাঁথা মালা' এই প্রথম তার কণ্ঠে শুনলাম। এরম একটা সাংস্কৃতিক জায়গায় এসে একটু গান বাজনা হবেনা? দলের বাকিদের অনুরোধেই মনেহয় সবাই একটু সঙ্গীত নিবেদন করতে বাধ্য হয়েছে। আমি স্মরণজিতের একটা বই হাতে বারান্দাতেই বসে কান পেতে শুনছিলাম। 

রোদ জ্বলা নির্জন, নিস্তব্ধ দুপুর, সামনে দীর্ঘ সবুজ বাগান- এরম একটা পরিবেশের মাঝে বিষন্নতা পেয়ে বসলে কেমনটা লাগে বলেন তো? 

পড়ন্ত বিকেলে, বসন্তের মৃদু, শুঁকনো হওয়ায় মিশে যাওয়া কৃষ্ণচূড়ার গন্ধ, স্মরণজিত, শ্রীজাত, জয় গোস্বামী, হুমায়ূন আহমেদের পাতার ভাজে কোথাও শুঁকনো গোলাপ দিয়ে চিহ্নিত করা- 'শ্রাবণ'।

ওই মেয়েটির কাছে সন্ধ্যাতারা আছে। 




Comments

Popular posts from this blog

Clockwork Orange

Language as a Witness

What is The Lazy Eye?